কালীর আদিকথা
- সাবেকি ইতিহাস
- Nov 19, 2020
- 6 min read
Updated: Dec 22, 2020
সব প্রাণীকে কলন অর্থাৎ গ্রাস করে যে তিনিই কালী। আদ্যা শক্তির সংহারকারী রূপ। কালী কেবল কোনো এক মহিলা দেবী নন, একটি বিচার যাকে কখনো বিনাশ করা যায়না। তিনি কালো অথচ পরমাসুন্দরী। ভয়ংকর তার ভঙ্গী ! অথচ তিনি দয়াময়ী-করুণাময়ী মাতা। তিনি ঘাতক অথচ মাতৃস্বত্বাধারী। তিনি নগ্ন, মুন্ডমালিনী তবে তার রূপই তাঁর নগ্নতাকে ঢেকে দেয় এটাই তাঁর আভূষণ। তিনি মহাকালের অর্ধশক্তি, পাপ নাশিনী, রক্ত পিপাসী, মুণ্ডমালিনী, ভয়ঙ্করী। তিনি 'মহাকালী'।

চিত্রাঙ্কনে- Soumyadeep Banerjee
'কালী' শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। এই শব্দের অর্থ কৃষ্ণ বা কালো বা ঘোর বর্ণ। কাল শব্দের দুটি অর্থ রয়েছে: নির্ধারিত সময় ও মৃত্যু। কিন্তু দেবী প্রসঙ্গে এই শব্দের মানে 'সময়ের থেকে উচ্চতর'। কালীর বাসস্থান শ্মশানে, যেখানে সকল সুখ, দুঃখ, ক্রোধ, লালসা, উল্লাস, অহংকারের সমাপ্তি হয়।

কালী, চিত্র ১৭৭০
এখন প্রশ্ন ওঠে যেখানে পরিশীলিত সংস্কৃতিতে উপাসিতা সমস্ত মাতৃদেবীই বহু আবরণে-আভরণে সম্ভ্রান্তভাবে সুসজ্জিতা সেখানে এই দেবী নগ্ন কেনো ? এই প্রসঙ্গে পল্লব সেনগুপ্ত লিখেছেন, "কালিকা মূলত আদিমকালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারায় অনুবর্তন করে একাল পর্যন্ত এসেছেন। যেকোনো মাতৃ দেবীকেই যে হিন্দু ধর্মনির্ভর সংস্কৃতিতে 'ভগবতী' বলে উল্লেখ করা হয়। কালীমূর্তি তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা। প্রত্ন-প্রস্তর পর্বে নগ্না ভেনাস মূর্তি গুলিকে সংস্কৃত নৃত্ত্ববিদরা এক ধরনের উর্বরতা কেন্দ্রিক ধর্মধারার উপজীব্য বলে মনে করেন। এই 'ফিগারাইন' গুলিতে নারীত্বসূচক স্নেহচিহ্ন গুলিকে অত্যন্ত প্রকট ভাৱে দেখানো হত। নগ্নিকা মূর্তি ছাড়া এই ধরনের চিহ্ন (ভোগ তথা যোনি) সুস্পষ্ট করে দেখানো সম্ভব ছিলনা। সুতরাং ভগবতী নামের মূল উৎস ধরে কালিকা মূর্তির আদিমতম প্রকরণটি কি ধরনের ধর্ম ধারার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ছিল তা বোঝাই যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য কালিকা দেবীর এই উর্বরা দেবীর চরিত্রটি রূপান্তরিত হয়েছে"। কালী পূজার সাথে আদিমকালের সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, "আদিমতর কালে যখন মানুষ আগুনকে আয়ত্বে আনতে পেরেছিল তখন থেকেই যে আগুন গুহা মুখে জ্বালিয়ে হিংস্র জীব-জন্তুদের তাড়ানো হত তেমনি ভুত-প্রেত অশরীরী দের ওই আগুনের মাধ্যমে তাড়ানো সম্ভব ছিল বলে কল্পনা করা হত। তাই কালীকে মৃত্যুদেবী রূপে পূজা করা শুরু করলে অগ্নি প্রজ্বলনের সংস্কার এই দ্বীপ জ্বালানোর মধ্যে অনুবৃত হয়ে এল ধীরে ধীরে। কালীর মৃত্যু রূপা চরিত্র কল্পনার সূত্রেই পদতলে শবদেহের অবস্থান ঘটেছিল যা কালক্রমে শিব রূপে কল্পিত হতে থাকে। এছাড়া ভুত চতুর্দশীর দিন চৌদ্দ শাক সংগ্রহ ব্যাপারটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের আবছায়া ও ক্ষীণ স্মৃতি বহন করে। বলির ব্যাপারটাও পশু শিকার করে উপাস্য রূপে আগে কল্লিত দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করার ঐতিহ্যানুগত রূপান্তর বলাই যায়।"

কালী করালবদনা
দেবীমাহাত্ম্যম্, বরাহপুরাণ, মহাভারত, বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ, মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীভাগবত পুরাণ ও কালিকাপুরাণ প্রভৃতি প্রাচীন শাস্ত্রে কালী রূপের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া একাধিক তন্ত্র সাহিত্যে কালী মাহাত্মের বিবরণ রয়েছে। বঙ্গীয় তন্ত্রসার, শ্যামারহস্য প্রভৃতি তন্ত্রে উল্লেখিত কালীর রূপ গুলি হলো- দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, চামুন্ডাকালী, রক্ষাকালী, আদ্যাকালী ও মহাকালী প্রভৃতি। আবার বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী, করুণাময়ী প্রভৃতি নামে কালী পূজা হয়। অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের উল্লেখ আছে। তবে এঁদের মধ্যে দক্ষিণকালী বা শ্যামাকালী সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যাপকভাবে পূজিত। তার চার হাতে রয়েছে খড়গ, অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, বর ও অভয়মুদ্রা। তার গলায় রয়েছে নরমুণ্ডের মালা। দেবীর গায়ের রং কালো। মাথায় আলুলায়িত চুল এবং তিনি শিবের বুকে ডান পা আগে রেখে দণ্ডায়মান। ব্রহ্মযামল নামক তন্ত্রগ্রন্থের মতে, কালী বঙ্গদেশের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। এছাড়া মাঘ মাসের চতুর্দশী তিথিতে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজাও বিশেষ জনপ্রিয়। এছাড়াও ভাদ্র ও পৌষ মাসের অমাবস্যায় কালী পুজো বিশেষ জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যা এবং প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবারে কালীপূজা হয়ে থাকে। জুন ম্যাকডেনিয়েলের মতে, একটি গ্রামের কালী পরের গ্রামের কালীর সমান নয়। একজন চন্ডী ভাল শিকার দেয়, অন্য চণ্ডী রোগ নিরাময় করে। শাক্তদের ধারণা সমগ্র ভারত জুড়ে এক নয়। এগুলি কোনও ব্যক্তির উপজাতি বা বর্ণ গোষ্ঠী, পরিবার, পাড়া বা গ্রামেই নির্দিষ্ট।

ভদ্র কালী
ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তা রাজ্যে সুদূর অতীত থেকেই প্রবাহমান রয়েছে দুটি ধরা। একটি বৈদিক অন্যটি তান্ত্রিক। এই তন্ত্র সাধনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মূলত শক্তির উপাসনা। শাক্ত ধর্ম মূলত আর্য সংস্কৃতির বাইরের প্রদেশ গুলি বিশেষ করে বাংলা, উত্তর বিহার ও গুজরাটে বিকাশ লাভ করেছিল বলেই আর. পি. চান্দা মনে করেন। পি. সি. বাগচী অবশ্য তা মানতে রাজি নন। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, "কোনো পার্বত্য দেবী বা আঞ্চলিকতা থেকে শাক্ত ধর্মের সূত্রপাত হয়নি এর উৎপত্তি হয় মূলত শৈব ধর্ম থেকে। প্রাথমিক ভাবে শিব ও শক্তি পূজার প্রচলন ছিল কিন্তু পরবর্তী কালে শক্তির গুরুত্ব লোকসমাজে বাড়ে এবং সেখান থেকেই পৃথক শাক্ত আদর্শের উৎপত্তি।" ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, শাক্ত ধর্ম হয়তো স্থানীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে কিছুটা বিকশিত হয়েছে কিন্তু এর উৎস সন্নিহিত রয়েছে ধ্রুপদী শৈব দর্শনে, সেখান থেকে বিকশিত হয়েই আজকের তান্ত্রিক রূপ।

কালী, ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও, ১৮৮৫
শক্তি উপাসনা বঙ্গদেশে একটি সুপ্রাচীন বিশেষ সম্পদ। নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, খ্রিস্টত্তর সপ্তম-অষ্টম শতকের পূর্বেই বাংলাদেশের নানা স্থানে শক্তি পূজা প্রবর্তিত হয়েগেছিল। কেবল বাংলা নয়, উড়িষ্যাতেও এই সময় থেকে বিভিন্ন শাক্ত মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। একাদশ-দ্বাদশ শতকে বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে শাক্ত প্রতিমা পাওয়া গেছে। অধিকাংশই দুর্গা/মহিষমর্দিনী অথবা পার্বতী রূপে, তবে তান্ত্রিক রূপে বেশ কিছু চামুন্ডা মূর্তি উদ্ধার হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই বঙ্গদেশে 'চামুন্ডা' বা 'চর্চিকা' আরাধনার সূত্রপাত হয়েগেছিল, তবে বর্তমান কালী পূজা থেকে এটি অনেকটা আলাদা ছিল। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, মুসলিম আক্রমনের ফলে হিন্দু সমাজে ব্রহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির অবক্ষয় হতে শুরু করে, এই সময় জনগণের উপর থেকে ব্রাহ্মনদের অধিকার শিথিল হতে থাকে এবং প্রতিবাদী ও লুক্কায়িত ধর্মবিশ্বাস ও গোষ্ঠী সমাজের সামনে আসে এদের মধ্যে শাক্ত ও তন্ত্র ছিল অন্যতম।

অষ্টভুজা চামুণ্ডা, রাজশাহী, একাদশ শতক
মধ্যযুগের বঙ্গদেশে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণব আদর্শ প্রভাব বিস্তার করেছিল কিন্তু এই ধারা সমাজের সকল স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পূর্ব বাংলার নমঃশূদ্র বা চন্ডাল জাত শাক্ত রয়ে গেছিল। সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থরাও শাক্ত মত ছাড়েনি। ইতিহাসবিদ অনিরুদ্ধ রায় লিখেছেন, "সপ্তদশ শতাব্দীর লেখা থেকে বোঝা যায় যে সাধারণ লোক ও জমিদাররা মদ ও অন্যান্য ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিলেন এরা কীর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং গ্রাম থেকে বৈষ্ণবদের তাড়িয়ে দেয়। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বৈষ্ণবদের মধ্যে তন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটে। বৈষ্ণব সনাতন গােস্বামীর লেখায় এর আভাষ পাওয়া যায়। শাক্ত পীঠস্থান সাতটার বেশি ছিল না, কিন্তু তারা সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিল। ক্রমে এটি বেড়ে বাহান্নটি হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীর একটা পুথি থেকে জানা যায় যে এদের এক-তৃতীয়াংশই বাংলাতে ছিল। বাংলাতে শাক্ত ধর্মের জনপ্রিয়তা। পরিষ্কার। মুকুন্দরাম বহুসংখ্যক শাক্ত পীঠ বাংলাতে ছিল বলেছেন।"

কালীঘাট কালী
রামপ্রসাদ সেনের গুরু কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ বঙ্গদেশে প্রথম কালী পূজার রীতির প্রচলন করেন। সুধীর কুমার মিত্র মনে করেন, আবহমান কাল থেকে ঘটেই পূজা হয়ে আসত এবং সেই পূজা হত বিশুদ্ধ মন্ত্রে সাত্ত্বিক বিধানে। কিন্তু সপ্তদশ শতকে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম মৃন্ময়ী রূপে কালী বন্দনা করেন। মধ্যযুগে তন্ত্রের বিষয় আশয়ে অবিশুদ্ধতা প্রবেশ করে। এইসময় তান্ত্রিকরা বিভিন্ন ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ে যায়। ষষ্ঠদশ-সপ্তদশ শতকে এগুলি বার করে শুদ্ধতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। নবদ্বীপে তন্ত্রের আলোচনা প্রবল ভাবে প্রচলিত ছিল। আচারে বৈষ্ণব হলেও কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য নবদ্বীপে পন্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের টোলে তন্ত্রশাস্ত্র অধ্যায়ন করে তান্ত্রিক হয়ে যান এবং তাঁর নতুন নাম হয় কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি 'তন্ত্রসার' রচনা করে তন্ত্রে বিশুদ্ধতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। দেবী উপাসনা ও পূজা অনুষ্ঠান কিভাবে করতে হয় তা এই গ্রন্থে তিনি দেখিয়ে দেন। তিনিই প্রথম প্রতিমা নির্মাণ করে অমাবস্যায় এই পূজার অনুষ্ঠান করেন। যে কালী তিনি পূজা করেন তা আগমেশ্বরী কালী বলে পরিচিত হয়।কালীর যে মূর্তি শাস্ত্র মতে আগমবাগীশ নির্মাণ করেছিলেন তার রূপ বর্ননা ভরতচন্দ্র রায়গুনকার খুব সুন্দরভাবে তাঁর দশমহাবিদ্যায় বর্ননা দিয়েছেন-
মুক্তকেশী মহামেঘ বরণা দম্ভরা।
শবারুঢ়া করকাঞ্জি শব কর্ণপুরা।।
গলিত রুধিরধারা মুন্ডমালা গেলে।
গলিত রুধির মুন্ড বাম করতলে।।
আর বামকর যুগে কৃপান খরশান।
দুই ভুজে দক্ষিণে অভয় বরদান।।
লোল জিহ্বা রক্ত ধারা মুখের দুপাশে।
ত্রিনয়ন অর্ধচন্দ্র ললাটে বিলাসে।।
আগমবাগীশ স্বপ্নে আদেশ পান কালীর প্রসন্ন ভাবমূর্তি রচনা করার। স্বপ্নে দেবী তাঁকে জানান পরবর্তী ভোরে যে নারীকে তিনি সর্বপ্রথম দেখবেন তার রূপ অনুযায়ী কালীর এক প্রসন্ন প্রতিমূর্তি তৈরী করতে। পরবর্তী ভোরে যে নারীকে প্রথম তিনি দেখেন সে কৃষ্ণবর্ণা, তার ডান পা সামনে, উন্মুক্ত কালো কেশ এবং বাম হাত উত্তোলনের দ্বারা দেয়ালে গোবর স্থাপন করছেন। আকস্মিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে সামনে দেখে সেই মহিলা খুব লজ্জা পেলেন এবং তার জিহ্বা বার করে দাঁত দিয়ে চাপলেন। সেই নারীর রূপ অনুসরণ করে আগমবাগীশ মহাশয় কালীর মূর্তিতত্ত্ব অনুযায়ী দক্ষিণা কালীর মূর্তি রচনা করেছিলেন। এর আগে যন্ত্রে কালীপূজা হতো।

আগমেশ্বরী মাতা
১৭৬৮/১৭৭৭ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি/শ্যামাসপর্যাবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। কথিত আছে, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

উনিশ শতকে মুদ্রিত কালীঘাট কালী, ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও
আধুনিক যুগে কালীর বন্দনার আরেক পন্থা গড়ে ওঠেছিল। অষ্টাদশ শতকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় সর্দারদের নেতৃত্বে ডাকাত দল গড়ে ওঠে। পথচলতি ধনী ব্যাক্তিদের লুঠপাট অথবা অভিজাতদের বাড়ি হানা প্রভৃতি করে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের নিয়ে একাধিক রোমহর্ষক গল্প কাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। এই ডাকাতদের প্রধান আরাধ্যদেবী হয়ে ওঠে কালী যা ডাকাত কালী রূপেও পরিচিতি লাভ করে। নরবলি দেওয়া এই কালী বন্দনার প্রধান আচার হয়ে উঠেছিল। প্রাথমিক ভাবে এই ধরনের কালী মূর্তি গুলির কোনো মন্দির ছিলনা, পরবর্তীকালে ডাকাতদের দাপট কমলে স্থানীয় মানুষজন এই কালী মূর্তি গুলিকে কেন্দ্র করে মন্দির গড়ে তোলে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে, বনে-জঙ্গলে অথবা জনবসতিতে এরূপ একাধিক ডাকাত কালীর মন্দির আজও রয়েছে।

১৮৪১ সালে কলকাতায় কালীমূর্তি নিয়ে শোভাযাত্রা
তথ্যসূত্র:
১) সুধীরকুমার মিত্র: দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী, ডি. এম লাইব্রেরী, ১৯৫৮
২) পল্লব সেনগুপ্ত: পূজা-পার্বণের উৎসকথা, পুস্তক বিপণি, ১৯৫৯
৩) সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৯১
৪) অনিরুদ্ধ রায়: মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস; দ্বিতীয় খন্ড। প্রগতিশীল প্রকাশক, ২০১৮
৫) শশীভূষণ দাশগুপ্ত: ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, সাহিত্য সংসদ, প্রথম সংস্করণ
৬) নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালীর ইতিহাস; আদিপর্ব, দে'জ পাবলিশিং, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ
৭) পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়: বাঙ্গালীর পূজাপার্বণ, অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ
৮) কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ: বৃহৎ তন্ত্রসার, নবভারত পাবলিশার্স, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ
৯) R. C. Majumdar: The History of Bengal; volume I, Hindu period. Published by University of Dacca, 1943
১০) R.C Majumdar: History of Ancient Bengal, G. Bharadwaj & Co. 1971
১১) Narendra Nath Bhattacharya: History of Shakta religion, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd. 1974
১২) Hillary Peter Rodrigues: Ritual Worship of the Great Goddess; The liturgy of the Durga Puja with interpretations, State University of New York Press, Albany 2003
১৩) June Mcdaniel: Offering Flowers, Feeding Skulls; Popular Goddess Worship in West Bengal, Oxford university press, 2004
◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images
Commenti