top of page
Search

বাংলা মুদ্রণের বিশ্বকর্মা

  • Writer: সাবেকি ইতিহাস
    সাবেকি ইতিহাস
  • Dec 21, 2020
  • 3 min read

Updated: Dec 22, 2020

ঠুং ঠাং ঠকাং, কর্মকারের কর্মসালার নিত্যনৈমিত্তিক শব্দ। রোজই শোনা যায়। কিন্তু লেখকের গৃহে ? শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ। খুব বেশি হলে পাখির দু একটা কিচিরমিচির, মন্দ নয় ! তবে কেউ যদি সাহিত্য কর্মসালায় রচনা করেন ? সেকি ! এ হয় নাকি ? লঙ্কা দিয়ে পায়েস খাওয়া যায় নাকি ? কখন কি দিয়ে কি খাওয়া যায় বলতে পারবোনা, কিন্তু কর্মসালায়ও সাহিত্য রচনা করা যায়। যদি আপনি লিপিকার হনতো। বঙ্গদেশের গ্রামে শহরে বহু লিপিকার আজও রয়েছেন। কাঁসা-পিতলের থালা-বাটিতে নাম লেখার কাজ করেন। অনেকে আবার ফলক-টলকও লেখেন। তেমনি হুগলী জেলার এক অখ্যাত লিপিকার বাংলা ভাষায় প্রথম পুস্তক ছাপিয়ে ইতিহাস তৈরী করেন। অনেকে তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন 'বাংলার গুটেনবার্গ' রূপে ! কিন্তু না না করেও সেই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকেই টেনে হিচড়ে চাপিয়ে দাও। তাই আমাদের কাছে পঞ্চানন বাবু হলেন 'বাংলা মুদ্রণের বিশ্বকর্মা'।


ree

পঞ্চানন কর্মকারের জন্ম স্থান-কাল নিয়ে সংশয় আছে। এ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে জন্ম তাঁর। আবার অনেকের মতে ত্রিবেণীতে কর্মসূত্রে গেছিলেন, জন্মেছিলেন হুগলীর জিরাটে। তাঁর জন্ম সাল এখনো অধরা। কেউ কেউ বলেন ১৭৪০-এর দশক আবার কেউ বলেন ১৭৫০-এর দশকে তাঁর জন্ম। যাইহোক, পূর্বপুরুষদের উপাধি ছিল মল্লিক; তাঁরা লিপিকারের কাজ করতেন। তাম্রপট, অস্ত্রশস্ত্র, ধাতুপাত্র ইত্যাদিতে নামাঙ্কন ও অলঙ্করণ করাই ছিল তাঁদের পেশা। জন্মসূত্রে তিনি এই দক্ষতা অর্জন করেন।


ree

পঞ্চানন কর্মকারের টাইপ তৈরীর মেশিন।


বাংলায় ইংরেজরা ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। কিন্তু এদেশ শাসন করতে হলেতো সবার আগে এদেশের ভাষা বুঝতে হবে। সাত সমুদ্র পেরিয়ে আশা সাহেবদের পক্ষে তাতো খুবই কঠিন কাজ। এমন সময় এলেন ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড সাহেব। ইংরেজদের জন্য রচনা করলেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। হুগলিতে খ্রিস্টান মিশনারির ফাদার এন্ড্রুজ একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। স্যার চার্লস উইলকিন্স ওই পুস্তকের জন্য কাস্টখণ্ডে অক্ষর খোদাই করে বাংলা হরফ প্রস্তুত করেন এবং পঞ্চাননকে ছেনি প্রস্তুত করার পন্থা শিখিয়ে দেন। তারপর পঞ্চানন কর্মকার তাঁর ব্যবহারিক প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে ধাতব হরফ তৈরি করেন। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথম বাংলা মুদ্রণাক্ষরের প্রচলন হয়। ১৭৭৮ সালে প্রথম বাংলা হরফের ব্যাবহারে মুদ্রিত হয় হ্যালহেড সাহেব রচিত, 'A Gramer of the Bengal Language'। ইংরেজিতেই লেখা এই ব্যাকরণ, তবে উদাহরণের উদ্ধৃতি গুলি সব রামায়ন, মহাভারত এবং ভরতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর থেকে গৃহীত ও বাংলা হরফেই মুদ্রিত। সুধীর কুমার মিত্রের মতে, "১৭৭৮ সালে হুগলীতে বাংলা হরফের জন্ম হয় এবং সেই সময় হইতেই বাংলা গদ্য সাহিত্যের উন্নতির শুরু।"


ree

প্রথম বাংলা হরফের ব্যাবহারে মুদ্রিত পুস্তক


এরপর, ১৭৭৯ সালে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর উৎসাহ এবং উইলকিন্সের পরিচালনায় কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হলে উইলকিন্স পঞ্চাননকে কলকাতায় নিয়ে যান এবং সেই ছাপাখানায় কাজ করার সুযোগ করে দেন। তারপর কুড়ি বছর পঞ্চাননবাবু সেখানেই কাজ করেন। ১৭৯৯ সালে তাঁর সাথে উইলিয়াম কেরির যোগাযোগ হয় এবং ওই বছরই পঞ্চাননবাবু কেরি সাহেবের শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে যোগ দেন। একটি পুরোনো মেশিন নিয়ে কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই ছাপাখানাটি এশিয়ার বৃহত্তম প্রিন্টিং প্রেসে পরিণত হয়। শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের জন্যে পঞ্চানন কর্মকার এক সেট বাংলা হরফ নির্মাণ করে দেন। এই হরফে কেরী সাহেবের নিউ টেস্টামেন্ট-এর বাংলা অনুবাদ (১৮০১) মুদ্রিত হয় যার নাম ছিল 'মঙ্গল সমাচার'। ১৮০৩ সালে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে তিনি কেরীর সংস্কৃত ব্যাকরণের জন্য এক রাশ দেবনাগরী হরফ তৈরি করেন। ভারতবর্ষে দেবনাগরী ভাষায় হরফ তৈরি ছিল এটাই প্রথম। এই মিশন প্রেস থেকেই ১৮১৮ সালের ২৩শে মে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় যার নাম ছিল সমাচার দর্পণ। পরবর্তী কালে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান লেখা ছাপা হয়েছিল এই ছাপাখানা থেকে। সুতরাং শ্রীরামপুরই হয়ে ওঠে পঞ্চাননের প্রধান কর্মক্ষেত্র। এখানেই তাঁর একটি বাড়ি ছিল, তবে কালের নিয়মে সেটি বর্তমানে আর নেই।


ree

পঞ্চানন কর্মকারের বাড়ি


পঞ্চাননবাবুর ছাপার পদ্ধতিটি উইলকিন্সর সাহেবের কাছ থেকেই শেখা। ছোট একটি ধাতব খণ্ডের (স্থানীয় ভাবে বলা হয় ছেনি) উপর ছোট হাতুড়ি ও অন্যান্য সুক্ষ যন্ত্রপাতি দিয়ে অক্ষর রচনা করা হত। সেই ছেনিকে একটি ছাঁচে ফেলে তার মধ্যে গলন্ত সীসা ঢেলে দেওয়া হত। এইভাবে অক্ষরের ব্লক গুলি তৈরি হতো। তারপর ব্লক গুলিকে সঠিকভাবে সাজিয়ে কালি মাখিয়ে পাতার উপর মেশিন দিয়ে চাপ দিলেই ছাপানো সম্পূর্ণ ! ইউরোপে গুটেনবার্গ এই পদ্ধতিই ব্যাবহার করেছিলেন। তবে পদ্ধতিটি মোটেও সহজ ছিলোনা। সুধীর কুমার মিত্র বলেছেন, "কেরী সাহেবের ১২০ পাতার লেখা ছাপাতেই সময় লেগেছিল ১১ মাস।" এই পদ্ধতিতে ৮০০ পাতার পুস্তক ছাপাতে কত সময় লাগে ? আপনারাই হিসেব করেনিন।


ree

পঞ্চানন কর্মকার ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি


শেষ বয়সে পঞ্চানন কর্মকার তাঁর জামাতা মনোহর কর্মকারকে এই বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন। তিনি বাংলা ছাড়াও আরবি, ফারসি, চীনা, মারাঠি, প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালার হরফ তৈরি এই শিল্পকে বঙ্গদেশে আরো সম্প্রসারিত করেন। তবে পঞ্চানন কর্মকারের অবদান কোনো অংশেই লঘু ছিলোনা। বাংলা হরফে মুদ্রণ হয়তো কল্পনাই হয়ে যেত পঞ্চানন কর্মকার ছাড়া। ১৮০৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তবে বাংলা সাহিত্য ও মুদ্রণে তিনি অমর থাকবেন। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাস হয়তো কম কথা বলে কিন্তু তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মুদ্রণ শিল্পের বিশ্বকর্মা।



তথ্যসূত্র:

১) সুধীর কুমার মিত্র: হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, প্রথম খন্ড, মন্ডল বুক হাউস, ১৯৬২ ২) সুধীর কুমার মিত্র: হুগলী জেলার ইতিহাস, শীশীর পাব্লিশিং হাউস, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ ৩) শ্রীরামপুর মহকুমার ইতিহাস, ১৯০২ ৪) শ্রীরামপুর পরিচিতি, শ্রীরামপুর পৌরসভা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ ৫) ইন্দ্রনীল মজুমদার: বাংলার গুটেনবার্গ পঞ্চানন কর্মকার, ২০১৯ https://www.literacyparadise.com ৬) গৌতম বসুমল্লিক: পঞ্চানন কর্মকার, তাঁর হাতেই ছাপার হরফ পেল বাংলা, ২০১৯ https://eisamay.indiatimes.com ৭) Horace Hayman Wilson [Ed. By E. R. Rost]: Works; Vol. III, Trubner & Co, 1865


◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images

 
 
 

Comments


bottom of page