top of page
Search

কলিকাতা আবিষ্কার

  • Writer: সাবেকি ইতিহাস
    সাবেকি ইতিহাস
  • Dec 12, 2020
  • 4 min read

Updated: Dec 22, 2020

আবিষ্কারের কিছু নেই। ভূগোলে এই স্থানটি বহুদিন ধরেই বর্তমান রয়েছে, এবং অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তি বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ফেলেছেন। তবুও বিবর্ধক কাঁচের তলায় থেকে ঝাপসা হয়ে রয়েছে, চোখে পড়েনা আমাদের। আছে তবু নেই। তাই একঅর্থে আবিষ্কার। তবে এই প্রবন্ধকে আবিষ্কার না বলে দৃষ্টি আকর্ষণ বলাই উপযুক্ত হবে, কারণ বিষয়টিতে ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন আছে।


ধর্ম মন্দির, কলিকাতা-রসপুর, হাওড়া


কলকাতা থেকে অনতি দূরে অবস্থিত ছোট্ট অখ্যাত একটি গ্রাম, নাম তার কলিকাতা। অজ্ঞে হ্যাঁ, কলিকাতা। আশেপাশের গ্রামের লোক যদি বলে, "আমরা কলিকাতায় থাকি" অবাক হবেননা। বঙ্গ রাজধানী থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরত্বে হাওড়া জেলার পশ্চিমদিকে আমতা থানার অন্তর্ভুক্ত 'বাংলার দুঃখ' দামোদর নদীর তীরে অবস্থিত সমৃদ্ধ জনপদ রসপুর, এবং সেই রসপুর জনপদে বিরাজ করছে এই 'কলিকাতা' গ্রাম। লোকমুখে যেটি প্রচলিত 'রসপুর কলিকাতা' বা 'ছোট কলিকাতা' রূপে। আসলে ইতিহাস, ভুগল, জীবন বিজ্ঞান-ভৌত বিজ্ঞান এসবের নিয়মেই দস্যু নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামটি দামোদর নদীর এই গ্রামটির মানুষদের কাছে বড় ভাইয়ের স্থান অর্জন করেছে। তাই ইংরেজ সাহেবদের উচ্চারিত "Calcutta" হলো বড়দা, 'বড় কলিকাতা' বা 'আসল কলকাতা' এবং সময়ের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এই গ্রামটি তার অজান্তেই ছোট ভাইয়ে পরিণত হয়েছে।


কালী মন্দির, কলিকাতা-রসপুর, হাওড়া


'শুকতারা’য় প্রকাশিত 'নো নাম্বার ডাকছে' ভূতের গল্পটিতে ছোট কলকাতার উল্লেখ রয়েছে-

"পরদিন নাে নম্বরের নির্দেশ মেনে আমতা রুটের বাস ধরে শেষ স্টপে যখন নামলাম তখন সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। কোন দিকে যাব ভাবছি, আবার নির্দেশ রায়গুণাকর সেতু ধরে ছােট কলকাতার দিকে হাঁটতে থাকুন। তাই করলাম। গ্রামের দিকে রাত একটু তাড়াতাড়িই নামে। এখন আবার শীতকাল। আটটার মধ্যে পুরাে গ্রাম জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। গ্রামের নামটা অদ্ভুত। ছােট কলকাতা ! ভদ্রলােককে জিজ্ঞাসা করতে হবে তাে !"


একটি ওষুধের দোকান, কলিকাতা-রসপুর, হাওড়া

যুগবানী সঙ্ঘ পাঠাগার কলিকাতা-রসপুর, হাওড়া


বিনয় ঘোষ তাঁর 'পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি' গ্রন্থে এই 'ছোট কলিকাতা' গ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন বঙ্গদেশে একই নামের একাধিক গ্রাম আছে। একই জেলা, একই মহকুমা, এমনকি একই থানার মধ্যে এক নামের একাধিক গ্রাম দেখা যায়। এই বিষয়টি মোটামুটি সবাই জানি। তাহলে এত এরকম গ্রাম থাকতে পারে জেনেও এই একটি গ্রাম নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কিসের ? বাড়াবাড়ির কিছু নয়। আসলে সমস্যা গ্রাম নিয়ে নয় গ্রামটির নাম নিয়ে এবং তার সাথে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে শহর কলকাতার নামকরণ নিয়ে। ইংরেজ ফিরিঙ্গি সাহেবরা কলকাতার নামকরণ নিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করেছেন এবং এদেশী লেখকরা সাহেবদের একই কথাকে পুনরাবৃত্তি করেছেন, এমনটা বিনয় ঘোষ মনে করেন। তাই 'কলকাতা' নামকরণের সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজন রয়েছে। এই নামকরণ নিয়ে অনেক গুলি ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যেমন- ১) কলিকাতা নামের উৎপত্তি হয়েছে, অনেকের মতে, 'কালীঘাট' শব্দের বিকারে। ২) 'কালীকোটা' বা 'কালীকোঠা' (কালীর কোঠা বা ঘর, অর্থাৎ কালীমন্দির) থেকে ফিরিঙ্গী বিকৃতি 'কলিকাতা'র উৎপত্তি। ৩) 'কালীক্ষেত্র' থেকে 'কলিকাতা'র উৎপত্তি। ৪) 'কিলকিল' থেকে 'কলিকাতা'র উৎপত্তির কথা কেউ কেউ বলেন। ৫) একদা এক ইংরেজ সাহেবের এই অঞ্চলের নাম জানবার বাসনা হয়। তখন কলিকাতায় লােকের তেমন বসতি ছিল না। সাহেব দেখেন, একজন হিন্দুস্থানী ঘাসুড়ে ঘাস কাটছে। তাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, জায়গার নাম কি? হিন্দুস্থানী ভড়কে গিয়ে ভাবল, সাহেব বােধ হয় কবে ঘাস কাটা হয়েছে তাই জিজ্ঞাসা করছে। সে বলে, "হুজুর, কল কাটা" অর্থাৎ কাল কেটেছি। সাহেব মনে করলেন, জায়গার নাম 'কলকাটা' এবং এবং তাই খেকে ক্যালকাটা এবং তার বঙ্গানুবাদ 'কলিকাতা' বা 'কলকাতা' হল। এরকম কত অজস্র ধারণা রয়েছে। তবে ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ এই সব জল্পনাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁর কাছে এগুলি ছিল নিছক আজগুবী কল্পনা।


কালীঘাট মন্দির, কলকাতা


এই ধরনের জল্পনার প্রাবল্যের জন্যই অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দুঃখ করে বলেছিলেন, "দেড়শত বৎসরের অধিককাল ধরিয়া ভারতে ব্রিটিশরাজ্যের রাজধানী হইবার গৌরব ছিল যে নগরীর সেই কলিকাতা নগরীর নামের ব্যুৎপত্তি এখনও নির্ধারিত হইল না, ইহা বড় আশ্চর্যের বিষয়।" সেই সুনীতিবাবু কলিকাতা নামের ব্যুৎপত্তি সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন সেটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন, "কলিকাতা একটি খাঁটি বাংলা শব্দ। ইহার অর্থ, 'কলি' বা কলিচূনের জন্য 'কাতা' বা শামুকপােড়া। সুতার নুটী বা গােলার হাট বা আড়ত হইতে যেমন 'সুতানুটী' নাম, তেমনি কলির বা চুনের ও কলিচুনের জন্য শামুকের আড়ত, এবং চুনের কারখানা হইতে 'কলি-কাতা' নাম।"

তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার এই চুন তৈরির ব্যাবসা ছোট-বড় উভয় কলিকাতায় প্রচলিত ছিল/আছে (লুপ্ত প্রায়)। ১৮৫০ সালে, এফ. ডাব্লু. সিমস্ সাহেব কলিকাতা শহর সার্ভে করে একটি রিপাের্ট প্রকাশ করেন। এই রিপাের্টে দেখা মায়, 'ডিহি কলিকাতা'র প্রাচীন তৌগােলিক সীমানার মধ্যে কম করেও তিনটি রাস্তা ছিল চুন ও চুনারীদের নামে। যথা, চুনাপুকুর লেন : ৭২২ ফুট-বাই-১৬৯ ফুট ; উত্তরবিভাগ, র্লক নং দুই। চুনাগলি : ৭৭০ ফুট-বাই-২৩°৪ ফুট ; উত্তরবিভাগ, ব্লক নং তিন। চুনারপাড়া লেন : ৯২০ ফুট-বাই-১৪ ফুট ; উত্তরবিভাগ, ব্লক নং চার। মাত্র একশ বছর আগেও কলকাতার এই অঞ্চলে বিশাল একটি চুনারীদের পাড়া ছিল। চুনের বাণিজ্যের দিক থেকে চুনারপাড়ার এই অবস্থান অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। ডিহি কলিকাতার অনেকটা অংশ এবং প্রধান অংশ জুড়ে ছিল চুনারপাড়া, চুনাগলি ও চুনাপুকুর। আজও এই অঞ্চলে এই নামের অস্তিত্ব রয়েছে, যদিও চুনারীদের কোন পাড়া আর নেই। বড় বড় সারবন্দী মাটির পণে শামুক পুড়িয়ে কলিচুন তৈরি করত চুনারীরা। ঘরবাড়ি চুনকামের জন্যে যে চুন ব্যবহার করা হত তা কলিচুন এবং তার জন্য চুনকাম করাকে 'কলি দেওয়া' বা 'কলি ফেরানাে' বলা হয়। সুতরাং কলিচুনের কাতা বা আড়ত থেকে (চুন তৈরির সারিবদ্ধ পণকেও কলিচুনের কাতা বলে) 'ডিহি কলিকাতার নামকরণ হয়েছিল বলে মনে হয়।


চুলায় পোড়ানো হচ্ছে শামুক ও ঝিনুক


একইভাবে একদা দামােদরের তীরের এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান কলিচুন তৈরির ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল ছোট কলিকাতা। অনেক চুনারীরা তখন বসবাস করত। এখন সেখানে চুনারীদের বাস খুবই কম। তবে পরিত্যক্ত পণ ও বিক্ষিপ্ত শামুকের খােলের স্তূপ দেখে বােঝা যায়, কলিচুন তৈরির রেওয়াজ এখনও কলিকাতা গ্রামের চুনারীদের মধ্যে আছে।


কলিকাতা বিধান মানব বিকাশ সমিতি, কলিকাতা-রসপুর, হাওড়া


সুতরাং উক্ত বিষয়টি বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এক সময় কলিচুনের কাতা বা আড়ত থেকেই ভাগীরথীর পূর্বে ও পশ্চিমে দুটি গ্রামের নাম কলিকাতা হয়েছিল। পূর্বতীরের গ্রামটি ব্রিটিশ শাসকদের প্রয়ােজনে গ্রাম থেকে নগর ও মহানগরে পরিণত হয়েছে, আর পশ্চিমতীরের দামােদরসংলগ্ন গ্রামটি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়েগেছে। আড়াইশো বছরে তার অবনতি ছাড়া কোন উন্নতি হয়নি, বিনয় ঘোষ অন্ততপক্ষে তেমনটাই মনে করেন।



তথ্যসূত্র:

১) বিনয় ঘােষ: পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, পুস্তক প্রকাশক, ১৯৫০ ২) বিনয় ঘােষ: Notes on the History of Old Calcutta, ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেট, ৬১ খন্ড, ১৫ সংখ্যা। ৩) সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়: 'কলিকাতা' নামের ব্যুৎপত্তি, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ৪৫ বর্ষ, ১ম সংখ্যা। ৪) হরিসাধন মুখোপাধ্যায়: কলিকাতা সেকালের ও একালের, পি. এম. বাকচি এন্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯১৫ ৫) দীপক দাস: হাওড়ার কলকাতা, ইতিহাস ছুঁয়ে, ২০১৭

http://www.jathaichchatathaja.com/ ৬) F. W. Simms: Report on the Survey of Calcutta, 1851


◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images


Google Maps-এ অবস্থান: Kalitala, West Bengal 711401 https://maps.app.goo.gl/V7nbeGTcQjC4t7R88

 
 
 

Comments


bottom of page