top of page
Search

জগন্মাতা জগদ্ধাত্রী

  • Writer: সাবেকি ইতিহাস
    সাবেকি ইতিহাস
  • Nov 23, 2020
  • 3 min read

Updated: Dec 22, 2020

জগদ্ধাত্রী, অর্থাৎ জগতের ধারণকর্ত্রী বা পালিকা। উপনিষদে তাঁকে বলা হয়েছে উমা হৈমবতী। দেবী ত্রিনয়না, চতুর্ভূজা ও সিংহবাহিনী। তার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও পঞ্চবাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়। কেন উপনিষদ, দেবী ভাগবত পুরাণ ছাড়াও জগদ্ধাত্রীর প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় মায়াতন্ত্রে, বৃহস্পতি রায়মুকুটের স্মৃতিরত্নহারে (পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক), কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারে (ষোড়শ শতক) এবং শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির কৃত্যতত্ত্বার্ণবে।


চিত্রাঙ্কনে: Soumyadeep Banerjee

শ্রী শ্রী জগদ্ধাত্রী, ক্যালকাটা আর্ট স্টুডিও (১৮৮৫)


জগদ্ধাত্রী আরাধনা বিশেষত বঙ্গদেশেই প্রচলিত তবে এই পূজার প্রচলন বাংলায় খুব বেশী প্রাচীন নয়। অনেকেই মনে করেন জগন্মাতা জগদ্ধাত্রী পূজার প্রথম প্রচলন করেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, জমিদারীর রাজস্ব বাকি পড়ায় নবাব আলীবর্দী খাঁ কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গেরে বন্দি করেন। আলীবর্দী জানতেন দুর্গা পূজার সময় তাঁর সমস্ত রাজস্ব মহারাজা নিশ্চিত পরিশোধ করবেন, তাঁর এই আশা পূর্ণ হলে কৃষ্ণচন্দ্রকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র দেখেন মহানবমী পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তখন মহারাজা দেবী দুর্গাকে অঞ্জলি দেওয়ার আশায় দ্রুত মুঙ্গের থেকে কৃষ্ণনগর রওয়ানা হয়েছিলেন, কিন্তু সময় মতন পৌঁছনো সম্ভব হয়নি। নবমীর সন্ধ্যায় রুকুনপুরের ঘাটে অগ্রদ্বীপের কাছে খুৎপিপাসায় কাতর রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন তিনি স্বপ্নাদেশ পান এক সিংহরূঢ়, চতুর্ভুজা দেবীর, যিনি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে আগামী শুক্লা নবমীতে তাঁর আরাধনা করতে এবং একত্রে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুষ্পাঞ্জলি দিতে নির্দেশ দেন। তবে এই কাহিনীর স্থান-কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে মনে করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে মুর্শিদাবাদে বন্দি করা হয়েছিল এবং তাঁর মুক্তির দিনটি ছিল বিজয়া দশমী। নৌকায় চড়ে কৃষ্ণনগর ফেরার পথে বিসর্জনের বাজনা শুনে কৃষ্ণচন্দ্র বোঝেন যে দিনটি বিজয়া দশমী এবং সেই বছর তিনি দুর্গা আরাধনা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এতে তাঁর মনক্ষুন্ন হয়। সেইদিন রাতে তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পান এবং এইভাবেই জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন হয়। অন্য আরেক মতে ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয়েছিল। কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন।


কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা


রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন যা বুড়িমার পূজা নামে পরিচিতি লাভ করে। প্রথম দিকে এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে, স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন।


বুড়িমার পূজা, কৃষ্ণনগর


ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। অনেকে আবার মনে করেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িতে আগে থেকেই জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন ছিল, কিন্তু ফরাসীদের সাথে ইংরেজদের সপ্তবর্ষ যুদ্ধ চলাকালীন ১৭৫৭ সালে রবার্ট ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমন করলে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির পূজা বন্ধ হয়ে যায় এবং ১৭৬২ সাল নাগাদ লক্ষীগঞ্জে পুনরায় এই পূজার প্রচলন হয়। চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর (মতান্তরে শশধর) বন্দ্যোপাধ্যায় চাঁদা তুলে এই পূজা অব্যাহত রেখেছিলেন যা পরবর্তী কালে 'আদি মা' নামে খ্যাত হয়।


আদি মা, চাউলপট্টি, চন্দননগর


১৮৬৪ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহ রচিত হুতোমপ্যাঁচার নক্সাতে জগদ্ধাত্রী পুজার অসাধারণ বিবরণ পাওয়া যায়;

বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু – ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি – সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেঁপু বাজাচ্চে – হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট!... বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কাম্‌ড়াচ্চে দেখে, বাবু মহাত্মার বড়ই রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে – ‌

তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি। মানুষ মেলে টের্‌টা পেতে তোমায় বেতে হতো হরিণবাড়ী। সুর্কি কুটে সারা হোতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।। পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্র্যান্‌বুড়ি। সিঙ্গি মামা টের্‌টা পেতেন ছুট্‌তে হতো উকীলবাড়ী।।

গান গেয়ে, প্রণাম করে চলে গেলেন।


বাগবাজার সার্বজনীন, চন্দননগর


সুধীর কুমার মিত্র লিখেছেন, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজার চেয়ে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার খ্যাতি দীর্ঘদিনের। এখনার মত এত প্রকান্ড ও নানা মনোহর ডাকের সাজে শুসজ্জিতা দেবী জগদ্ধাত্রী প্রতিমা বাংলাদেশে আর কোন জায়গায় হয় না। এখনকার প্রতিমার উচ্চতা হয় কুড়ি থেকে পনের ফুট এবং অর্ধচন্দ্রাকৃতি চলচিত্র সমেত উচ্চতা হয় প্রায় ত্রিশ ফুট। চন্দননগরের মতন এত জাঁকজমক ও সাড়ম্বরে জগদ্ধাত্রী পূজা পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও হয়না। কালের বিবর্তনে এই পূজা এখন চন্দননগরের সীমানা ছাড়িয়ে ভদ্রেশ্বরের তেলিনীপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।


চন্দননগরের আলোকসজ্জা, ২০১৬


নিশ্চিত ভাবেই, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা কলকাতার দুর্গা পূজা গুলিকে জোর টক্কর দিয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা এবং কলকাতার দুর্গাপূজার প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে একটাই, সাহেব তোষণ। কেবলমাত্র স্থান-কাল-পাত্রের তফাৎ।



তথ্যসূত্র:


১) সুধীরকুমার মিত্র: দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী, ডি. এম লাইব্রেরী, ১৯৫৮

২) কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ: বৃহৎ তন্ত্রসার, নবভারত পাবলিশার্স

৩) সুধীর কুমার মিত্র: হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, প্রথম খন্ড, মন্ডল বুক হাউস, ১৯৬২

৪) অশোক মিত্র: পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা, দ্বিতীয় খন্ড, অনু প্রেস, ১৯৬৮

৫) কালীপ্রসন্ন সিংহ: হুতোমপ্যাঁচার নক্সা, বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড (কলকাতা)

৬) June Mcdaniel: Offering Flowers, Feeding Skulls; Popular Goddess Worship in West Bengal, Oxford university press, 2004


◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images

 
 
 

Comments


bottom of page