বাংলার ভুত
- সাবেকি ইতিহাস
- Dec 12, 2020
- 4 min read
Updated: Dec 22, 2020
"ভূত আমার পুত,
পেত্নী আমার ঝি..
রাম-লক্ষণ সাথে আছে,
করবি আমার কি!"
বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল ভূত। ভূতে বিশ্বাস করে না, এমন মানুষ সারা বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলার লোকগাথার এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে ভূতের গল্প। সেই সঙ্গে আছে ভূতের বাড়ি বা ভুতুড়ে বাড়ি, গাঁ-গঞ্জ-শহর সর্বত্র, আনাচে কানাচে। প্রতিটা ভুতুড়ে বাড়ির সাথে জড়িয়ে রয়েছে হাড় হিম করা ভুতুড়ে গল্প। প্রচলিত ধারণা হল, যারা মৃত্যুর পরে পরলোকে গিয়ে শান্তি পায় না, অথবা যাদের মৃত্যু অপঘাতে, তারা প্রেতাত্মা হয়ে পৃথিবীতেই রয়ে যায়। এই অশরীরী প্রেতাত্মাকেই আমরা সাধারণ ভাষায় বলি – 'ভূত'।

বাংলা সংস্কৃতিতে অনেক ধরনের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে; তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো-
ব্রহ্মদৈত্য: এই ধরনের ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এরা সাধারনত কারো ক্ষতি করে না। বাঙালি ব্রাহ্মণরা অপঘাতে মারা গেলে ব্রহ্মদৈত্য হয়৷ সাদা ধুতি, খালি গায়ে পৈতে পরে এরা আশ্রয় নেয় বেল গাছে৷ বেগতিক দেখলেই যখন তখন যেকোনও কারও ঘাড়ে চেপে বসতে পারে এরা৷

ব্রহ্মদৈত্য
পেত্নী: পেত্নী হলো নারী ভূত যারা বেঁচে থাকতে কিছু অতৃপ্ত আশা ছিল এবং অবিবাহিতভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। এসব ভূত সাধারনত যে কোন আকৃতি ধারন করতে পারে, এমনকি পুরুষের আকারও ধারণ করতে পারে। পেত্নীরা সাধারনত ভীষণ বদমেজাজী হয়ে থাকে এবং কাউকে আক্রমনের পূর্ব পর্যন্ত স্পষ্টতই মানুষের আকৃতিতে থাকে। পেত্নীদের আকৃতিতে একটিই সমস্যা রয়েছে, তা হলো তাদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো। জলা জায়গা বা শ্যাওড়া গাছে বাসা বাঁধে পেত্নিরা৷

পেত্নী
শাকচুন্নি: শাকচুন্নি শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচূর্ণী থেকে এসেছে। বিবাহিত মহিলারা মৃত্যুর পর শাকচুন্নি হয়৷ আর তাই হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদূর পরে এদের অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়৷ মৃত্যুর পরও বিবাহিত জীবনের শখ, আহ্লাদ ত্যাগ করতে পারে না এরা৷ তাই সাধারণত বিবাহিত নারীদের ওপর ভর করে শাকচুন্নিরা৷ লোকগাঁথা অনুসারে তারা আম গাছে বসবাস করে।

শাকচুন্নি
চোরাচুন্নি: চোরাচুন্নি অত্যন্ত দুষ্ট ভূত। এরা মানুষের অনিষ্ট করে থাকে। সাধারনত কোন চোর মৃত্যুবরণ করলে চোরাচুন্নিতে পরিনত হয়। পূর্ণিমা রাতে এরা বের হয় এবং মানুষের বাড়িতে ঢুকে পড়ে অনিষ্ট সাধন করে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাড়িতে গঙ্গাজলের (হিন্দু সংস্কৃতিতে গঙ্গা জলকে পবিত্র জল হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ব্যবস্থা করা হয়।

চোরাচুন্নি
স্কন্ধকাটা/কন্ধকাটা/কবন্ধ: এই ভূতেরা মাথাবিহীন হয়ে থাকে। সচরাচর এরা হলো সেইসব লোকের আত্মা যাদের মৃত্যুর সময় মাথা কেটে গেছে যেমন, রেল দুর্ঘটনা বা অন্য কোন দুর্ঘটনা। এ শ্রেণীর ভূতেরা সবসময় তাদের হারানো মাথা খুঁজে বেড়ায়।

স্কন্ধকাটা/কন্ধকাটা/কবন্ধ
পেঁচাপেঁচি: এ ধরনের ভূত সচরাচর দেখা যায় না। পেঁচাপেঁচি ভূত ধারনাটি পেঁচা থেকে এসছে এর স্ত্রী বাচক হলো পেঁচি। এরা জোড়া ধরে শিকার করে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জঙ্গলে এদের দেখা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়। এরা সাধারনত জঙ্গলে দুর্ভাগা ভ্রমণকারীদের পিছু নেয় এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় ভ্রমণকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে ও এরা শিকারের মাংস ছিড়ে ছিড়ে খায়।

পেঁচাপেঁচি
মেছোভূত: এ ধরনের ভূতেরা মাছ খেতে পছন্দ করে। মেছো শব্দটি বাংলা মাছ থেকে এসেছে। মাছ প্রিয় বাঙালিরা মৃত্যুর পরও মাছের লোভ ছাড়তে না পারলে মেছোভূত হয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়৷ রাত বা ভর দুপুরে নির্জন রাস্তা দিয়ে কেউ মাছ কিনে ফিরলেও এরা ঘাড়ে চেপে বসে৷

মেছোভূত
দেও: এধরনের ভূত নদীতে বা লেকে বসবাস করে। এরা লোকজনকে পানিতে ফেলে ডুবিয়ে মারে বলে বিশ্বাস করা হয়।

দেও
নিশি: ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের কন্ঠে নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বেরকরে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সারা দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ফিরে আসে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিনত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনী অনুসারে নিশিরা কোন মানুষকে দুবারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই কেউ তিনবার ডাকলে বের হওয়া উচিত তাতে নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।

নিশি
মামদো ভূত: হিন্দু বিশ্বাস মতে, এটি মুসলমান আত্মা। মামদো কথাটি এসেছে মহম্মদ থেকে৷ বাঙালি ব্রাহ্মণরা মারা গেলে যেমন ব্রহ্মদৈত্য হয়, তেমনই মুসলমানদের অপঘাতে মৃত্যু হলে তারা মামদো ভূত হয়৷ মামদোরা ঘাড়ে চাপলে বলা হয় জিন ভর করেছে৷

মামদো ভূত
কানাভুলো: এ শ্রেণীর ভূতেরা পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয় এবং অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে মানুষ একই রাস্তায় বারবার ঘোরপাক খেতে থাকে। ভূতরা কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌচ্ছার পর তার শিকারকে মেরে ফেলে।

কানাভুলো
গেছোভূত: গেছো ভূত গাছে বসবাস করে। গেছো শব্দটি গাছ (বৃক্ষ) শব্দ থেকে এসেছে।

গেছোভূত
আলেয়া: রাতের অন্ধকারে জলাভূমিতে বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া দেখা যায়। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোককথায় একে ভৌতিক আখ্যা দেওয়া হলেও বিজ্ঞানীরা মনে করে গাছপালা পচনের ফলে যে মার্শ গ্যাসের সৃষ্টি হয় তা থেকে আলেয়া এর উৎপত্তি।

আলেয়া
ডাইনী: ডাইনী মূলত কোন আত্মা নয়, এরা জীবিত নারী। বাংলা লোকসাহিত্যে সাধারনত বৃদ্ধ মহিলা যারা কালো জাদু বা ডাকিনীবিদ্যাতে পারদর্শী তাদেরকেই ডাইনি বলা হয়ে থাকে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, ডাইনীরা গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে তাদের হত্যা করে এবং তাদের হাড়, মাংস ও রক্ত খেয়ে একশত বছর বেঁচে থাকে।

ডাইনী
বেঘোভূত: এরা হলো সেইসব মানুষের আত্মা যারা বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। সাধারনত সুন্দরবন এলাকায় এধরনের ভূতের কথা বেশি প্রচলিত কারণ বাঘের অভাশ্রম হলো সুন্দরবন। এসব ভুতেরা জঙ্গলে মধু আহোরনে আগত গ্রামবাসীদের ভয় দেখায় এবং বাঘের সন্নিকটে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে এরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য বাঘের স্বরে ডেকে উঠে।

বেঘোভূত
ঝেঁয়ো পেত্নী: সাধারণত ঝাউগাছে এরা নিজেদের লুকিয়ে রাখে। ভরসন্ধ্যাবেলায় পথিক যদি একা একা সেই ঝাউবন বা জঙ্গল পেরুতে যায়, তখন তাকে ধরে ঝাউয়ের মগডালে চড়িয়ে দেয় এ জাতীয় পেত্নীরা।

ঝেঁয়ো পেত্নী
ডাকিনী: ডাইনি বুড়িদের অনুগতশ্রেণির ভূত। পাতিহাঁস খেতে খুব ভালোবাসে এরা। থাকে পুকুর বা দিঘীর ধারে কোনো তাল বা নারিকেল গাছে। রাতদুপুরে মেয়েলোকের বেশে ঘুরে বেড়ানো এদের অন্যতম অভ্যাস।

ডাকিনী
ঠাকুমার ঝুলিতে আমরা আরো অনেক ধরনের ভুতের উল্লেখ পাই। এই ভুত গুলির গঠনগত বিবরণে তৎকালীন গ্রাম বাংলার সমাজের ছাপ স্পষ্ট। গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তাদের রীতিনীতি, গাছ-পালা এবং জীব-জন্তুদের ভৌতিক ছবি মানুষের দুর্বল মনে স্থান করে নিয়েছে এবং সেই ভয় থেকেই গড়ে উঠেছে ওঝা ও তান্ত্রিকদের বাড়বাড়ন্ত। তবে কংক্রিটের জঙ্গলে তেমন ভুতুড়েভাব নেই বরং রয়েছে ভুতের অভাব।

◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images
Comments