শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়
- সাবেকি ইতিহাস
- Nov 15, 2020
- 9 min read
Updated: May 4, 2021
বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে পালিত হয় এই উৎসব। তবে এই উৎসবের ইতিহাস খুব একটা সরল নয়। প্রথম পূজার স্থান কাল পাত্র নিয়ে রয়েছে বিবাদ। পূজার আচার আচরণ রীতিনীতির পরিবর্তন, চিন্ময়ী থেকে মৃন্ময়ী রূপ ধারণ, পূজা থেকে উল্লাস; উল্লাস থেকে উৎসব, দেখনদারী থেকে তোষামোদ, আরাধনা থেকে প্রতিযোগিতা, রীতি থেকে সংস্কৃতি বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়ে এই উৎসবের বিবর্তন হয়েছে। সুখ্য ঘট থেকে বিশালাকার দশভুজা প্রতিমা হয়ে ওঠার ঘটনা। নানান মোড় নিয়েই আজ গড়ে উঠেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব 'দুর্গোৎসব'।
প্রাচীন বেদে দেবী দুর্গার কোনো বর্ননা নেই। অনেকে ঋকবেদের দেবীসুক্ত-কে দুর্গার সুক্ত বলেই মনে করে থাকেন, তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন উক্ত সুক্ত অগ্নি আরাধনায় ব্যবহৃত হত। যাইহোক মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী ভাগবত প্রভৃতি প্রাচীন পুরান ও উপপুরান গুলি থেকে আমরা দুর্গার বিবরণ পেয়ে থাকি। পুরান মতে তিনি দুর্গা দুর্গতিনাশিনী, আদি শক্তি মহামায়া তথা শিবের স্ত্রী পার্বতীর উগ্ররূপ এবং শাক্তদের অন্যতম পরম পূজিত ঈশ্বর।

মহিষমর্দিনী (অষ্টাদশ শতাব্দী)
মুসলিম আক্রমনের পূর্বে শাক্ত ধর্ম বাংলায় ঠিক কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বলা কঠিন। আর. পি. চান্দা মনে করেন শাক্ত ধর্ম মূলত আর্য সংস্কৃতির বাইরের প্রদেশ গুলি যেমন বাংলা, উত্তর বিহার ও গুজরাটে বিকাশ লাভ করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য তাতে একমত নয়।
পি. সি. বাগচী এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, কোনো পার্বত্য দেবী থেকে শাক্ত ধর্মের সূত্রপাত হয়নি এর উৎপত্তি হয় মূলত শৈব ধর্ম থেকে। প্রাথমিক ভাবে শিব ও শক্তি পূজার প্রচলন ছিল কিন্তু পরবর্তী কালে শক্তির গুরুত্ব লোকসমাজে বাড়ে এবং সেখান থেকেই পৃথক শাক্ত আদর্শের উৎপত্তি। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন, শাক্ত ধর্ম হয়তো স্থানীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে কিছুটা বিকশিত হয়েছে কিন্তু এর উৎস সন্নিহিত রয়েছে ধ্রুপদী শৈব দর্শনে। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, খ্রিস্টত্তর সপ্তম-অষ্টম শতকের পূর্বেই বাংলাদেশের নানা স্থানে শক্তি পূজা প্রবর্তিত হয়েগেছিল।
একাদশ-দ্বাদশ শতকে পাল-সেন আমলে বঙ্গদেশে একাধিক দুর্গা প্রতিমা পাওয়া গেছে। সমকালে মহিষাসুরমর্দিনী রূপটি সর্বাধিক খ্যাত ছিল। দ্বিভুজা থেকে অষ্টাদশভুজা একাধিক দেবী মূর্তি এই যুগে পাওয়া গেছে, এর মধ্যে চতুর্ভুজা ও দন্ডায়মান মূর্তির সংখ্যাই বেশি। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, পাল যুগের অধিকাংশ মূর্তি আগম ও যামল গ্রন্থ বাখ্যায়িত শৈবধর্ম থেকে উদ্ভূত এবং শাক্ত ধর্মের প্রাক-তান্ত্রিক রূপ।

বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত অষ্টাদশভুজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি (দ্বাদশ শতাব্দী)
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে প্রথম দুর্গা আরাধনার উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়নে। এর পূর্বে অবশ্য সন্ধাকর নন্দী রচিত রামচরিতে বরেন্দ্রিতে দুর্গা পূজার উল্লেখ রয়েছে কিন্তু অনেকে মনে করেন তা সম্ভবত বসন্তকালের পূজা। মার্কণ্ডেয় চণ্ডী অনুযায়ী, বসন্ত ঋতুতে রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধি দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন করেছিলেন, যা অনুষ্ঠিত হত বসন্ত কালে। কিন্তু মা দুর্গার অকালবোধনের ধারণা কৃত্তিবাসী রামায়ণের পূর্বে ছিলনা। বাল্মিকি রামায়নে বা তুলসী দাসের রামচরিতে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার উল্লেখ না থাকলেও কৃত্তিবাসী রামায়নের লঙ্কাকাণ্ডের 'রাবণ বধের জন্য শ্রীরামের প্রতি দেবীর আদেশ ও দশমী পূজা সমাপন' অংশে অকাল বোধনের উল্লেখ রয়েছে–
অকালবোধনে পুজা কৈলে তুমি দশভুজা
বিধি মতে করিলে বিন্যাস ।
লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য
অবনীতে করিলে প্রকাশ ।।
রাবণে ছারিনু আমি বিনাস করহ তুমি
এত বলি হইলা অন্তরধান ।
নাচে গায় কপিগণ প্রেমানন্দে নারায়ণ
নবমী করিলা সমাধান ।।
দশমীতে পূজা করি বিসর্জিয়া মহেশ্বরী
সংগ্রামে চলিলা রঘুপতি ।
আদেশ পাইয়া রাম সিদ্ধ কৈল মনস্কাম
চণ্ডীলীলা মধুর ভারতী ।।
কৃত্তিবাসী রামায়নে দেবীর মৃন্ময়ী রূপের কল্পনা এবং আচার আচরণের স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সুধীর কুমার মিত্র বঙ্গদেশে মৃন্ময়ী দুর্গাপূজা প্রচলনের জন্য মহাকবি কৃত্তিবাসকে কৃতিত্ত্ব দিয়েছেন।

রামচন্দ্রের অকাল বোধন
ভবিষ্যপুরাণ অনুযায়ী অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গের আদিবাসী এবং নিম্ন বর্ণের মানুষরাই দুর্গা পূজা করত। বিভিন্ন শাক্ত পুরাণে দুর্গাকে অন্যান্য অনেক দেবীর রূপের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নব দুর্গা (নয়টি দুর্গা) পাদ্ দুর্গা, গুপ্ত দুর্গা, কনক দুর্গা প্রভৃতি। এই রূপ গুলিকে প্রকৃতির দেবী রূপে তন্ত্র সাধনার সহিত পূজা করা হত। এছাড়া ছিল সুলিনি দুর্গা, জয় দুর্গা এবং বন দুর্গা। এই রূপ গুলি বিভিন্ন আঞ্চলিক উপজাতিদের দেবী রূপে পূজিত হয়। এই দেবী গুলি হল বিভিন্ন আঞ্চলিক দেবী, কাঠ ও পাথরের ফলকের উপর নির্মিত। জুন ম্যাকডেনিয়েল মনে করেন, এই দেবী গুলি নির্দিষ্ট স্থান, মন্দির, অঞ্চল এবং দর্শন প্রবাহের সাথে জড়িত। একটি গ্রামের কালী পরের গ্রামের কালী সমান নয়। একজন চন্ডী ভাল শিকার দেয়, অন্য চণ্ডী রোগ নিরাময় করে। শাক্তদের ধারণা সমগ্র ভারত জুড়ে এক নয়। এগুলি কোনও ব্যক্তির উপজাতি বা বর্ণ গোষ্ঠী, পরিবার, পাড়া বা গ্রামেই নির্দিষ্ট। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, মুসলিম আক্রমনের ফলে হিন্দু সমাজে ব্রহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির অবক্ষয় হতে শুরু করে, এই সময় জনগণের উপর থেকে ব্রাহ্মনদের অধিকার শিথিল হতে থাকে এবং প্রতিবাদী ও লুক্কায়িত ধর্মবিশ্বাস ও গোষ্ঠী সমাজের সামনে আসে এদের মধ্যে শাক্ত ও তন্ত্র ছিল অন্যতম।

শাল গাছের দুর্গা, দেবী শালেশ্বরী
মধ্যযুগের বঙ্গদেশে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে বৈষ্ণব আদর্শ প্রভাব বিস্তার করেছিল কিন্তু এই ধারা সমাজের সকল স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। পূর্ব বাংলার নমঃশূদ্র বা চন্ডাল জাত শাক্ত রয়ে গেছিল। সমাজের অনেক প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থরাও শাক্ত মত ছাড়েনি।
অনিরুদ্ধ রায়ের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীর লেখা থেকে বোঝা যায় যে সাধারণ লোক ও জমিদাররা মদ ও অন্যান্য ব্যাভিচারে লিপ্ত ছিলেন এরা কীর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন এবং গ্রাম থেকে বৈষ্ণবদের তাড়িয়ে দেয়। তিনি মনে করেন সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে বৈষ্ণবদের মধ্যে তন্ত্রের ঘটে।
তবে দুর্গা পূজার প্রচলন ঘটলে বৈষ্ণব অভিজাতরাও তা আপন করে নেয়। কিন্তু তা তন্ত্র মতে নয় বৈষ্ণব মতে হত, বলিহীন অনুষ্ঠান। দেবী দুর্গার সাথে বৈষ্ণব কুলদেবতাদেরও পূজা চলত। অনেক স্থানে বৈষ্ণব রীতি মেনে দুর্গা পূজায় রথ টানার প্রথা শুরু হয়। এছাড়া রথযাত্রার সহিত কাঠামো পূজার সময় কাল জুড়ে যায়। এইভাবেই বৈষ্ণব ও শাক্ত গোষ্ঠীর প্রথাগতভাবে সংমিশ্রণ লক্ষণীয় হয়ে পড়ে। তবে গোঁড়া বৈষ্ণবরা সম্ভাবত এই সংমিশ্রণ মানেনি।
তবে এই মৃন্ময়ী দেবীকে চিন্ময়ী রূপে কে প্রথম বরণ করেছিল ? তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। লোকমতে সর্ব প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন দিনাজপুরের রাজা গণেশ, পঞ্চদশ শতকে যিনি ইয়াশ শাহী বংশের রাজত্বের সমাপ্তি ঘটিয়ে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করেছিলন। প্রতি বছর শরৎকালে মৃন্ময়ী প্রতিমা নির্মাণ করে দুর্গাপূজা করে তা বিসর্জন দেওয়ার রীতি তিনিই প্রথম চালু করলেছিলেন বলে মনে করা হয়। এছাড়া অনেকের মতে ষোড়শ শতকে রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংশনারায়ণ রায় শারদীয়া উৎসবের প্রথম প্রবর্তক। তবে আরো পূর্বে খ্রিস্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা জগৎমল্ল প্রথম মৃন্ময়ী দুর্গার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু তা একটি আঞ্চলিক দেবী রূপেই প্রচলিত থাকে সার্বিক প্রচার তেমন হয়নি। ১৬১০ সালে লক্ষিকান্ত রায় এবং রাজা বসন্ত রায় বড়িশায় (বেহালায়) একটি আটচালা ভবনে শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন যা কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা বলে মনে করা হয়। S. Roy মনে করেন বাস্তবে এই পূজা ১৫৮৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী দেবী

সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপূজা
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য মনে করেন, বর্তমানে আমরা যে দুর্গা পূজাকে চিনি তা মূলত চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতকের মধ্যে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু সুধীর কুমার মিত্র মনে করেন, মুসলিম আমলে দুর্গাপূজা মুষ্টিমেয় অভিজাত বাড়ি (বিশেষ করে যারা প্রশাসনের সাথে যুক্ত) ছাড়া আর কোথাও হতনা। যদিও কোথাও পূজা হতো তা হতো ঘট স্থাপন করে খুব সংক্ষেপে এবং গোপনে। মুসলিম আমলে নবাব যদি জানতে পারে যে কোনো ব্যাক্তি প্রতিমা স্থাপন করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পূজা করছে তাহলে ছলেবলে কৌশলে নবাব (শাসক) তার অর্থ কেড়ে নিত। বঙ্গদেশে পাঁচশো বছর আগে যে প্রতিমা পূজার প্রচলন ছিল এমনটা তিনি মনে করেননা। মুসলিম যুগে এক অধটা ঘটনা ছাড়া অধিকাংশ পূজাই হত ঘটে।

দুর্গাপূজার ঘট
মৃন্ময়ী দুর্গাপূজার প্রচলনে বর্তমান যে রূপে দুর্গোৎসব পালন করা হয় তার নিশ্চিত কৃতিত্ত্ব ছিল নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের। অষ্টাদশ শতকে শরৎকালে তিথি মেনে বাংলা চলার দুর্গা প্রতিমার পূজা করেন, এবং এই প্রতিমাপূজা সমাজে খ্যাতি লাভ করে। কেবল দুর্গা পূজাই নয় শক্তি আরাধনায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সর্বাধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী ও শাক্তরাস প্রচলনের কৃতিত্ত্বও তাকেই দেওয়া হয়। তাঁর সভায় শাক্তপদাবলী, অন্নদামঙ্গলের ন্যায় মাতৃ আরাধনার বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হয়। কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে পূর্ববঙ্গের নাটোর থেকে বহু শিল্পীরা আসতেন। তারাই মূলত কৃষ্ণনগরের মৃত শিল্পকে বিখ্যাত করে তোলে এবং তাদের হাত ধরেই রাঢ় বাংলায় বর্তমান দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের ধারা গড়ে উঠে।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দুর্গাপূজা
১৭৫৭-র পলাশীর যুদ্ধ। নবাব সিরাজুউদৌল্লার পরাজয় এবং ইংরেজ শক্তির আধিপত্যের সূচনা। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর কলকাতার কথাচিত্র গ্রন্থে কলকাতার বুকে এক ভীষন বিজয় উল্লাসের উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভাবে তিনি লিখেছেন, "আমোদে-প্রমোদে মরা কলকাতায় আবার প্রাণের জোয়ার" এই ঘটনাকে স্মরণীয় করার উদ্দেশ্যে নবকৃষ্ণদেব দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধে জয় লাভের পর রবার্ট ক্লাইভ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সিরাজউদৌল্লার কলকাতা আক্রমনে শহরের একমাত্র চার্চ ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তখন ক্লাইভের মুন্সি নবকৃষ্ণদেব তাকে দেবীর কাছে প্রার্থনা করার জন্য দুর্গাপূজায় আহ্বান জানান। অনেকে অবশ্য মনে করেন নবকৃষ্ণদেব নিজের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য এইরূপ গল্প-কাহিনীর প্রচার করেছেন। যাইহোক, ওই বছর শোভাবাজার রাজবাড়িতে মহা ধুমধামে দুর্গাপূজা করা হয়। এইভাবেই পূজা পরিণত হয় বিজয় উল্লাসে।

১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে আয়োজিত দুর্গাপূজা, উপস্থিত ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ

শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো
নবকৃষ্ণদেবের দেখাদেখি এই প্রথা ততকালিন অভিজাত সমাজের মুল মন্ত্র হয়ে যায়। শরতের মনোরম আবহাওয়ায় রকমারি মরসুমি ফুল-ফল আর মিষ্টি দিয়ে সাদা চামড়ার ইংরেজ অধিকর্তাদের আপ্যায়ন করা সমকালীন অভাজত জমিদারদের মূল উদ্দেশ্য দাঁড়ায়। ইংরেজ অধিকর্তাদের খাতির যত্ন করে তাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন, তাদের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা অর্জন, সামাজিক প্রতিপত্তি লাভের জন্য রায়বাহাদুর উপাধির লোভ প্রভৃতি বিভিন্ন কারনে সাহেব খাতির চলত। শাস্ত্রাচার এই সব পূজায় গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যে পূজায় যত বেশি সংখ্যক আমন্ত্রিত ইংরেজ অতিথি উপস্থিত হতেন, সেই পূজার মর্যাদা ততই বাড়ত। দেবীপ্রতিমার সম্মুখেই মুসলিম বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজরা এসে নাচগান করতেন, তাদের জন্য উইলসন হোটেল থেকে গোরু ও শূকরের মাংস আনানো হত এবং মদ্যপানের আসরও বসত। এই ধারা চলেছিল ১৮৪০ সাল পর্যন্ত যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আইন জারি করে সাহেবদের পূজাপার্বনে উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে দেয়। এই প্রসঙ্গে মিস কিনসলি লিখেছেন, “when a black man has a complement a European, he treats him a Nautch”; ১২৩৬ বঙ্গাব্দের ২রা কার্ত্তিক শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত সমাচার দর্পণ দুর্গাপূজা সম্বন্ধে লিখেছিল, "সমারোহপূর্বক এই উৎসবকরণ অল্পকাল হইয়াছে এবং তাহা প্রায় কেবল বঙ্গদেশেই হইয়া থাকে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় প্রথমত এই উৎসব বড় জাঁকজমক করেন এবং তাঁহার ঐ ব্যাপার দেখিয়া কর্মে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের আমলে যাঁহারা ধনশালী হইলেন তাঁহারা আপনাদের দেশাধিপতির সমক্ষে ধনসম্পত্তি দর্শাইতে পূর্বমত ভীত না হওয়াতে তদৃষ্টে এই সকল ব্যাপারে অধিক টাকা ব্যয় করিতেছেন।" এই বিবরণ থেকে সুধীরকুমার মিত্র কলকাতার দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান গুলিকে আকর্ষণীয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এইভাবে কালকের উল্লাস পরিণত হয় আজকের উৎসবে।

১৮০৯ সালে অংকিত দুর্গাপূজার একটি চিত্র

১৮৩০-৪০এর দশকে অংকিত কলকাতার একটি দুর্গাপূজার চিত্র, উইলিয়াম প্রিন্সেপ
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বঙ্গদেশে ব্যাপকার্থে দুর্গাপূজা প্রচলনের পরে বিদেশ থেকে রপ্তানি করা সাদা ও রঙিন রাংতা দিয়ে প্রতিমার অঙ্গসজ্জ্যা করতেন শিল্পীরা। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জার্মানি থেকে আমদানি করা হতো রাংতা। যেহেতু ডাক ব্যাবস্থার মাধ্যমেই আসতো এই সরঞ্জাম তাই নাম হয় ডাকেরসাজ। তবে পরবর্তীকালে বাংলার শোলারডাক নিজস্ব পরিচিতি পায়। এই সাজের প্রচলন প্রায় সব অভিজাত পরিবার গুলোতেই শুরু হয়েযায়। তৎকালীন বঙ্গ সমাজে প্রতিমার সাজ দেখনদারী ও ইংরেজ তোষণের মূলমন্ত্র হয়ে যায়। এই সাজে প্রীতমাকে অনেকাংশেই মেম সাহেবের ন্যায় দেখতে লাগে। দেবীর চাকচিক্য বাড়ানোর জন্য এই সাজ ইংরেজদের সমকক্ষ হওয়ার একটি লক্ষ মাত্র। প্রথম দিকে দেবী দুর্গার মুখ ছিল বাঁশ পাতার মতো একটি সরু মুখ যা 'খাস বাংলা মুখ' নামে পরিচিত, কৃষ্ণনগরে প্রথম এই রীতি শুরু হয়। পরে মুখটি আরও গোলাকার হয়ে উঠল, যাকে 'দো ভাষী মুখ' বলা হয়। অবশেষে আরও স্বাভাবিক মুখশ্রী করা হয় যা 'ছোবিয়ানা' নামে পরিচিত। উলিলিয়াম জোন্স দুর্গাকে বলেছেন, দুর্গা সিংহের উপরে বসে, দশ দিক থেকে যাতে কোনো বিপদ এসে তার ভক্তগনকে বিপর্যস্ত করতে না পারে, তাই দশ হাতে দশ রকমের অস্ত্র তিনি ধারণ করেছেন।

ডাকের সাজে দেবী দুর্গা

খাস বাংলা মুখ শৈলী
কৃষ্ণনগরের শিল্পীরা ভালো আয়ের আশায় কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করে। এরাই ছিল পটুয়াপাড়া বা কুমারটুলির আদিবাসিন্দা। বঙ্গদেশে কোনো সিংহ ছিলনা, তাই সিংহ কেমন দেখতে হয় শিল্পীদের কাছে তার ধারণা ছিলনা। তাই কৃষ্ণচন্দ্র রায় বা নবকৃষ্ণদেবের বাড়ির দুর্গা প্রতিমায় সিংহের পরিবর্তে গোঁফযুক্ত সাদা ঘোড়াকে সিংহের রূপ দেওয়া হয়। পরে রাজভবন বা গভর্নর হাউসের ফটকের উপরে সিংহ চিত্র স্থাপনের মাধ্যমে ইউরোপীয় সিংহ শীঘ্রই কুমারটুলিতে প্রবেশ করেছিল যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়ে থাকে। গ্রান্ট সাহেব দেবী দুর্গা ও ব্রিটিশ আইকন ব্রিটিনায়র মিল খুঁজে পেয়েছেন। উভয়ই সিংহবাহিনী ত্রিশূলধারী। সুতরাং ব্রিটিশ ও বাঙালি সংস্কৃতির অসাধারণ মেল বন্ধন হয়ে ওঠে এই শারদৎসব। যেখানে একদিকে ছিল ব্রিটিশ আধিকারিকদের খাতির অন্য দিকে তাদের সামনে নিজের সমৃদ্ধতা ও মর্যাদা প্রদর্শনের এক অন্যতম পন্থা, এটা বোঝানোর জন্য যে তাঁরাও ব্রিটিশদের সমকক্ষ।

ঘোড়ার আদলে সিংহ
দেবীর স্বপরিবারে মর্তের আশার ধারণা খুবই বিচিত্র কারন সনাতনী শাস্ত্রে এইরূপ কোনো পূজার উল্লেখ নেই। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, প্রাচীন ও প্রাক-মধ্যযুগীয় সংস্কৃত সাহিত্যে শিব ও গৌরীর সন্তান রূপে গণেশ ও কার্তিকের প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল কিন্তু লক্ষী ও সরস্বতী সম্পর্কে সেইরকম কোনো ধারণা এই সময়ের সাহিত্যে পাওয়া যায়না। বাঙালির কল্পনায় এবং শিল্পে গৌরী বা উমার সংসারের গঠন দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পাদে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত কবিকঙ্কন চন্ডীতে শিব, লক্ষী, গণেশ, স্বরস্বতী ও কার্তিকের সঙ্গে দশভুজা চন্ডিকার সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী রূপের বর্ননা রয়েছে। সুতরাং দ্বাদশ-ত্রিয়দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝির মধ্যে দেবী সম্পর্কিত দুটি পৃথক কল্পনার মিলনে তাঁর এক নতুন রূপের জন্ম হয় যা শিল্পে প্রকাশিত হয়। উইলিয়াম ওয়ার্ড, বাঙালির দুর্গাপূজাকে শ্রেষ্ঠ পূজা রূপে সমহদিত করেছেন। তিনি মনে করেন দুর্গা হলো গ্রিক দেবী মিনার্ভ, পলল ও জুনিয়র সম্মিলিত বিগ্রহ।

স্বপরিবারে উমা
ঊনবিংশ শতকে বাংলায় বাবু সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, যাদের ছিল বিলাসবহুল জীবন ও ব্রিটিশ প্রভুদের কাছে আকর্ষনীয় হয়ে ওঠার ইচ্ছা। এই বাবুরা কার্তিক ঠাকুরের মধ্যে নিজেদের ছবি খুঁজে পায়। এর আগে সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের আদলে কার্তিকের প্রতিমা নির্মাণ করা হত যা ছিল শৌর্যের প্রতীক। কিন্তু এইসময় ওনেক অভিজাত বাড়ির পুজোয় কার্ত্তিকে ধুতি, কুর্তা ও পাগড়ি পরিয়ে জমিদার বাবুদের রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়। সম্ভবত কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার প্রথম এই রীতির প্রচলন করেছিল। এইভাবে এক রীতি পরিণত হয় সংস্কৃতিতে।

কার্তিকের বিশেষ সাজ
বারোয়ারি শব্দটির উৎপত্তি 'বারো' অর্থাৎ ১২ সংখ্যা ও 'ইয়ার' বা বন্ধু (উর্দুতে বন্ধুকে বলা হয় ইয়ার) শব্দদুটি থেকে। ১৭৯০ সালে হুগলির গুপ্তিপাড়ায় বারো জন ব্রাহ্মণ বন্ধু মিলে দুর্গাপূজা করবেন বলে মনস্থ করেন। প্রতিবেশীদের থেকে চাঁদা তুলে আয়োজিত হয় সেই পূজা। এইভাবেই বাংলায় যে সর্বজনীন পূজানুষ্ঠানের সূচনা হয় তা লোকমুখে 'বারোয়ারি পূজা' নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গুপ্তিপাড়ার এই পূজার প্রচলন দেখে বল্লভপুর, কোন্নগর, উলা, চাকদাহ, শ্রীপুর প্রভৃতি স্থানেও বারোয়ারি পূজার প্রচলিত হয়। এই পূজাকে নিয়ে গুপ্তিপাড়ার সহিত ওলা ও শান্তিপুরের অধিবাসীদের প্রতিযোগিতা আরোম্ভ হয়েছিল।

প্রথম বারোয়ারি পূজা সমিতি

বিংশ শতাব্দীতে বারোয়ারি পূজা আর বারোজনের উদ্যোগ থাকেনা, তা পরিণত হয় সর্বজনীন উৎসবে। ১৯১০ সালে ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি দুর্গাপূজা আয়োজিত করা হয়। এরপর একে একে ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ সালে শ্যামবাজারের শিকদারবাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান অর্থাৎ বর্তমান বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়। এই বারোয়ারি পূজা ব্যাপক প্রচলনের মধ্য দিয়ে বনেদি বাড়ির পুজো গুলির জৌলুশ ম্লান হতে শুরু করে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই সার্বজনীন পূজা গুলির প্রতিযোগিতা আজকের দিনে দুর্গাপূজাকে দিয়েছে এক অন্যমাত্রা। আরাধনা পরিণত হয়েছে প্রযোগীতায়। তবে আজো বিসর্জনের পরে বালক থেকে বৃদ্ধ, নারী থেকে পুরুষ, একাধিক বাঙালি পরিবারে প্রায় সবাই মিলে লেখে, 'শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়'।
তথ্যসূত্র:
১) সুধীরকুমার মিত্র: দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী, ডি. এম লাইব্রেরী, ১৯৫৮
২) পল্লব সেনগুপ্ত: পূজা-পার্বণের উৎসকথা, পুস্তক বিপণি, ১৯৫৯
৩) ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়: বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত। লেজার কম্পোজ এলবাট্রস, ২০০০
৪) অনিরুদ্ধ রায়: মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস; দ্বিতীয় খন্ড। প্রগতিশীল প্রকাশক, ২০১৮
৫) নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালীর ইতিহাস; আদিপর্ব, দে'জ পাবলিশিং, ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ
৬) ভবানী প্রসাদ রায় রচিত ও শ্রীব্যোমকেশ মুস্তফী সম্পাদিত: দুর্গা মঙ্গল। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দির. ১৩২১ বঙ্গাব্দ
৭) পূর্ণেন্দু পত্রী: পুরোনো কলকাতার কথাচিত্র
৮) কৃত্তিবাস ওঝা: কৃত্তিবাসী রামায়ন
৯) মুকুন্দরাম চক্রবর্তী; কবিকঙ্কন চন্ডী
১০) R. C. Majumdar: The History of Bengal; volume I, Hindu period. Published by University of Dacca, 1943
১১) R.C Majumdar: History of Ancient Bengal, G. Bharadwaj & Co. 1971
১২) Narendra Nath Bhattacharya: History of Shakta religion, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd. 1974
১৩) Jaya Chaliha and Bunny Gupta: Durga Puja in Calcutta, Calcutta The Living City Vol II, edited by Sukanta Chaudhuri, Oxford University Press, first published 1990, paperback edition 2005
১৪) Hillary Peter Rodrigues: Ritual Worship of the Great Goddess; The liturgy of the Durga Puja with interpretations, State University of New York Press, Albany 2003
১৫) June Mcdaniel: Offering Flowers, Feeding Skulls; Popular Goddess Worship in West Bengal, Oxford university press, 2004
◾চিত্র সংগ্রহ: Google Images
Comments