শ্রীরামপুরের গীর্জেতে
- সাবেকি ইতিহাস
- Dec 25, 2020
- 2 min read
সাঁঝের বেলা। শোভাবাজার রাজবাড়িতে বসেছে কবি গানের আসর। আসর একদম চরমে। চলছে কবির লড়াই। ভোলা ময়রা এন্টোনি ফিরিঙ্গিকে আক্রমণ করে বলে,
"তুই জাত ফিরিঙ্গি জবরজঙ্গী, পারবে না মা তরাতে তোকে পারবে না মা তরাতে শোনরে ভ্রষ্ট বলি স্পষ্ট, তুই রে নষ্ট মহাদুষ্ট তোর কি ইষ্ট কালীকেষ্ট, ভজগে যা তুই যীশুখৃষ্ট। শ্রীরামপুরের গীর্জেতে"
এখন এর ঐতিহাসিক প্রামাণ্য নিয়ে তর্কাতর্কি থাকতেই পারে, কিন্তু লোককোথায় এই দৃশ্য চির অমর। এর পাশাপাশি বাংলা চলচ্চিত্রে এই গানের প্রয়োগ অনেক সাধারণ মানুষের পরিচয় করায় শ্রীরামপুরের গির্জার সাথে। শ্রীরামপুরের গির্জা বলতে নিশ্চিত ভাবেই 'সেন্ট ওলাভ'স চার্চ'কে বোঝানো হয়েছে, যেখানে প্রার্থনা করতে যেতেন এন্টোনি ফিরিঙ্গি।

সালটা ১৭৫৫, শ্রীরামপুরের নিশান ঘাটে উড়লো দিনেমারদের পতাকে। ডেনিশ সাম্রাজ্যের অঙ্গ হয়ে ওঠে ভাগীরথী তীরের ছোট্ট একটি জনপদ। ডেনিশ শাসকদের তত্ত্বাবধানে যা পরিণত হয় নগরে। দিনেমার সম্রাট পঞ্চম ফ্রেডরিকের নামানুসারে তার নতুন নাম হয় ফ্রেডরিক নগর। এর মূল কারিগর ছিলেন কর্নেল ওলি বি (Olav Bie), ১৭৭৬ সালে শ্রীরামপুরের গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি এই জনপদটিকে একদম ইউরোপীয় নগরের ছাঁচে ফেলতে চেয়েছিলেন। শ্রীরামপুরে একাধিক অট্টালিকা নির্মাণে উদ্যোগীও হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল শ্রীরামপুরে একটি খ্রিষ্টান গির্জা নির্মাণ। এর জন্য শুরু হয় চাঁদা তোলার কাজ। চাঁদা আসে শ্রীরামপুর, কলকাতা, এমনকি সুদূর কোপেনহেগেন থেকেও। গির্জা নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৮০০ সালে এবং শেষ হয় ১৮০৬ সালে। কিন্তু গভর্নর ওলি বি-এর দুর্ভাগ্য তিনি সম্পূর্ণ নির্মিত গির্জাটি দেখে যেতে পারেননি। ১৮০৫ সালেই তার মৃত্যু হয়। ক্যাপ্টেন ক্রেফটিং-এর উদ্যোগে নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল। নরওয়ের সেন্ট ওলাভের নামে গির্জাটির নামকরণ করা 'সেন্ট ওলাভ'স চার্চ'।

গির্জাটি আদতে একটি লুথারিয়ান চার্চ। বিশেষজ্ঞরা মনেকরেন, দিনেমারদের উদ্যোগে নির্মিত হলেও গির্জার স্থাপত্যশৈলী প্রচলিত দিনেমার শৈলীর থেকে অনেকটা আলাদা। এই চার্চের নির্মাণে ব্রিটিশ ছোঁয়া বেশি দেখতে পাওয়া যায়। অনেকটা কলকাতার সেন্ট জন্স বা সেন্ট অ্যান্ড্রুস চার্চের মতন। গির্জার ছাদটি সম্পূর্ণ সামন। ঘরের সামনে দুই থাম বিশিষ্ট পোর্টিকো আছে। এর মধ্যে খোদাই করা আছে সেই সময়ের ড্যানিশ রাজা সপ্তম খ্রিস্টানের রাজকীয় মনোগ্রাম। পোর্টিকোর উপরে রয়েছে বেল টাওয়ারটি। এর মধ্যে একটি বিশাল ঘড়ি বিরাজ করে। গির্জার সুউচ্চ টাওয়ারটি গঙ্গার ওপারে ব্যারাকপুর থেকে দেখা যায়।


ব্রিটিশ চার্চ নির্মাতা রবার্ট আর্মস্ট্রং কর্তৃক ১৮০৬ সালে অংকিত সেন্ট ওলাভ চার্চের নকশা
© Danish National Archives
১৮৪৫ সালে দিনেমাররা ফ্রেডরিক নগর বিক্রি করেদেয় ইংরেজদের কাছে। সেন্ট ওলাভ'স চার্চের দায়িত্ব নেয় 'বিশপ অফ ক্যালকাটা'। অনেক পরে চার্চের ভার তুলে দেওয়া হয় শ্রীরামপুর কলেজের হাতে। তবে কালের নিয়মে গির্জাটি আসতে আসতে বেহাল জরাগ্রস্ত হয়েপরে। ২০০৯ সালে গির্জাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ডেনমার্ক এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় গির্জাটিকে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ২০১৬ সালে কাজ শেষ হলে সর্বসাধারণের জন্য গির্জাটি খুলে দেওয়া হয়। এরফলে এটি তার নতুন রূপে পুরোনো তাৎপর্যকে ফিরে পায়। এই সংস্কারের কাজকে ২০১৬ সালে UNESCO Asia Pacific Heritage Awards-এ সম্মানিত করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে শ্রীরামপুর তার পুরাতন ঐতিহ্যকে নবনির্মান করে ইতিহাস চেতনা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের এক নতুন দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছে।
তথ্যসূত্র:
১) সুধীর কুমার মিত্র: হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, প্রথম খন্ড, মন্ডল বুক হাউস, ১৯৬২ ২) সুধীর কুমার মিত্র: হুগলী জেলার ইতিহাস, শীশীর পাব্লিশিং হাউস, ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ ৩) শ্রীরামপুর মহকুমার ইতিহাস, ১৯০২ ৪) শ্রীরামপুর পরিচিতি, শ্রীরামপুর পৌরসভা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ ৫) প্রফুল্ল চন্দ্র পাল: প্রাচীন কবিওয়ালার গান, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ৬) বঙ্গদর্শন ইনফর্মেশন ডেস্ক: দিনেমার আমলের গল্প বলে শ্রীরামপুরের এই গির্জা, বঙ্গদর্শন; ইতিবাচক বাংলা, ২০২০ ৭) Restoration of St. Olav's Church, National Museum of Denmark.
Google maps-এ অবস্থান St Olav's Church Panchu Gopal Bhaduri Sarani, Tin Bazar, Serampore, West Bengal 712204 https://maps.app.goo.gl/BJbFoysrms5KS4Mh8
Comments